অঘোর মন্ডল:
গোটা পৃথিবীকে মৃত্যুর চাদরে মুড়ে বিদায় নিতে যাচ্ছে ২০২০ সাল। মৃতের সংখ্যা কত? সঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে সংখ্যাটা এবং খুব দ্রুত। আর আমরাও ২০২০-কে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গী ভয়, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা আর নিয়তি।
অথচ বছরটা শুরু হয়েছিল কত স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট করে দিল করোনা ভাইরাস! এ বছরটা শুধু মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয়নি। কেড়ে নিয়েছে কত প্রাণ। একসঙ্গে এত কীর্তিমান মানুষকে বাঙালি হারিয়েছিল গেল শতাব্দীর একাত্তরের ডিসেম্বরে। এবার সেই মৃত্যুর মিছিল লম্বা হতে শুরু করে মার্চে। সেই একাত্তরের মতো। ২০২০-এর মার্চ বাঙালির জীবনে নিয়ে হাজির হয় এক অজানা আতঙ্ক। অনিশ্চিত যাত্রা। যে অনিশ্চয়তা এখনো আমাদের সঙ্গী। যদিও স্বপ্ন বোঝাই তরী নিয়ে মন-সাগরে ভাসছি আমরা। ভ্যাকসিন এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার ফিরে পাব আমাদের স্বাভাবিক জীবন। যে জীবন পাল্টে গেছে মার্চে। ‘নিউ-নরমাল লাইফ’ নামের অ™ু¢ত-বিদঘুটে এক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা পা রাখতে যাচ্ছি নতুন বছরে।
কিন্তু ২০২০ বাঙালির জীবনে হতে পারত আনন্দ-উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে মোড়ানো এক বছর। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর। বছরজুড়ে কত আয়োজন থাকার কথা ছিল। করোনার বিষে বিষাক্ত দুহাজার বিশের সব আয়োজন থমকে গেছে। এবাবের মতো মার্চ আর কবে এসেছিল! যে মার্চ বাঙালির জীবনে স্বাধীনতা এসেছে, এবার সেই মার্চ থেকে রাতের ঘুম উধাও হয়েছে! করোনা সংক্রমণের ভয় শুরু সেই মার্চ থেকেই। যদিও পৃথিবীতে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় বছরের শুরু থেকে। তবে আমাদের দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত সেই ৮ মার্চ। তার পর থেকে মার্চ সত্যিই মারাত্মক এক মার্চ হয়ে হাজির হয় আমাদের জীবনে। এবার স্বাধীনতা দিবস থেকে দেশজুড়ে সাধারণ ছুটির মোড়কে আটকে রাখা হয় সাধারণ জীবনযাত্রা। যদিও তার আগেই চীনের উহান থেকে ইতালি, যুক্তরাজ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। পৃথিবীর গোঙানির শব্দ আমরা শুনেছি। আবার আমরা কান্নাভেজা গলায় গাইতে চেয়েছি জীবনে জয়গান!
২০২০ বিশ্বকে অনেক নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, স্যানিটাইজিং কত কী! সৌজন্য করোনা ভাইরাস। যা পৃথিবীকে রীতিমতো অসুখগ্রস্ত করেছে। কবে এই অসুখ থেকে সেরে উঠবে পৃথিবী তা কেউ জানেন না। বলতেও পারেন না। শুধু আশা, সবাই যখন করোনা টিকা পাবে; হয়তো পৃথিবীর অসুখও সেরে যাবে।
পৃথিবীর অসুখে বড্ড দুঃসময় পার করছে মানুষ। ২০২০ এক মহাবিপর্যয়ের কাল। এই সময়টাকে ভুলতে চায় মানুষ। কিন্তু ভোলা যায় না। ভুললে চলেও না। প্রত্যেকটা বিপর্যয়ের কাল জীবনকে বড় শিক্ষা দিয়ে যায়। বিদায়ী এ বছরটা এমনই এক বিপর্যস্ত সন্ধিক্ষণ হয়ে রইল। এই বিরল বছরকে ফিরে দেখতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয়। বিষাদের ছায়াকে সঙ্গী করে যে, বছরের প্রায় প্রতিটি দিন কাটল, তাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন! শুধু দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-বেদনা, নিরাশা আর তার বিপরীতে আশা! এই তো আমাদের জীবনে ২০২০! ক্যালেন্ডার থেকে এমন একটা বছরের পাতাগুলো দ্রুত ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। অনেকে চাইবেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বছরটাকে ইরেজ করে দিতে। ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, শিহরণ, মন খারাপ, বিচ্ছেদ, শোক, ঘাবড়ে যাওয়ার এমন বছর আগে কখনো আসেনি।
কী রাষ্ট্রীয় জীবন, কী সামাজিক জীবন, কী ব্যক্তিজীবন সর্বত্রই ইতিউতি আঁচড় বসিয়েছে করোনা। সেই আঁচড়ে আমূল বদলে গেল আমাদের জীবনযাপন।
জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায়-ল-ভ-। এমন বদলের বছর আগে আসেনি! সেই বদলের ছাপ রাজনীতিতেও। কিন্তু কতটা? না গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। ঘরে বসে ভার্চুয়াল রাজনৈতিক বক্তব্যই দিয়ে গেছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। ভাষা এক। বদলে গেছে শুধু জায়গাটা। করোনা রাজনীতিবদদেরও ঘরবন্দি করেছে। রাজনীতিকেও আটকে রেখেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে।
তবে ইতিবাচক অনেক বদলও ঘটেছে সমাজের বিভিন্ন জায়গায়। মহামারীর ছোবলে রেস্তোরাঁয় গিয়ে আমরা এমন সব ওয়েটার দেখছি, যারা পরিবেশন করছেন মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে। এমনভাবে যে, তাদের মুখটাও দেখা যাচ্ছে না? আগামীতে কবে দেখা যাবে, তাও জানি না। তবে এই পরিবর্তন খারাপ কী!
২০২০ সাল দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পাশাপাশি পেশাগত জগতে নিয়ে এসেছে ঝুঁকি এবং প্রতিবন্ধকতা। তা এড়াতে তৈরি হয়েছে নতুন পণ্য ও পেশা। মাস্ক-স্যানিটাইজার এখন আমজনতার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। মাস্কের চাহিদা বেড়েছে বিপুল। তার জোগান দিতে গড়ে উঠেছে নতুন নানা ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোগ। অনেকে আবার পুরনো পেশাকে সামান্য বদলে নিয়ে সময়োপযোগী করেছেন। গলির মোড়ের পরিচিত দর্জি এখন দিনভর কাপড়ের মাস্ক বানানোয় ব্যস্ত। স্যানিটাইজারের ব্যবহার বেড়েছে। মুদির দোকান থেকে ওষুধের দোকানেও স্যানিটাইজারের চাহিদাও বেড়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবসার রমরমা। সঙ্গে প্রটেকটিভ ফেস শিল্ড, পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), মেডিক্যাল প্রটেকটিভ গগল্স, মেডিক্যাল প্রটেকটিভ শু কভার! শুধু ছোট ব্যবসায়ী নন, বিশ্ববিখ্যাত ক্রীড়া সরঞ্জাম নির্মাতা সংস্থাগুলো এনেছে ‘ব্র্যান্ডেড মাস্ক’। তরুণ প্রজন্মের নতুন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। নয় মাস আগে পাল্স অক্সিমিটারের নাম না-শোনা আমজনতা সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে ঘরে সেটি মজুদ করেছে। দেহে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার সেই যন্ত্রের বেশিরভাগই আবার চীন থেকে আমদানি! শুধু বাংলাদেশ নয়, মহামারীর কারণে এশিয়া-ইউরোপের বহু দেশে করোনা টেস্টিং কিট আর ভেন্টিলেটর রপ্তানি করছে চীন। মারণ ভাইরাসের উৎপত্তি যেখানে সেই চীনের অর্থনীতিতে তার কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না।
মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির কারণে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের ‘সৌজন্যে’ জোয়ার এসেছে পরিচ্ছন্নতা এবং জীবাণুমুক্তকরণ সংক্রান্ত ব্যবসায়।
পৃথিবীর নানা দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বন্ধ। ফলে শিক্ষামূলক আর বিনোদনসংক্রান্ত অ্যাপগুলোর চাহিদা বেড়েছে। ইন্টারনেট গেমস এবং পাজ্লের জনপ্রিয়তা বাড়ায় বেড়েছে ব্যবসা। এমনকি করোনা-পরবর্তীকালে মানুষের বই পড়ার অভ্যাস বেড়ে গেছে ইউরোপ-আমেরিকায়। ঝোঁক এসেছে শরীরচর্চার। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হয়েছে। উন্নত দেশের সরণিতে থাকা বাংলাদেশ অবশ্য করোনাকালেও তার অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পেরেছে। সেটা দৃশ্যমান আমাদের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে। অর্থনীতির মেরুদ- এখনো সোজা আছে। লকডাউন জারি না করে সাধারণ ছুটির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু রাখতে পেরেছে। তার পরও আমরা চাইলেও ইতিহাস ভুলতে পারবে না ‘অর্থহীন’ ২০২০। যখনই অর্থনীতিতে ধাক্কা আসবে, তুলনা আসবে এই বছরের। আলোচনায় উঠে আসবে ২০২০ সাল।
‘সংক্রমিত-২০২০’ সাল। চাইব না, আবার ফিরে আসুক এমন কোনো ক্ষত। তবু অর্থনীতিতে, পরিসংখ্যান সবের আলোচনায় বারবার ফিরে আসবে ২০২০।
আশার কথা, করোনাকাল ফুরিয়ে আসছে। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে সংবাদ আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট, কিছুদিনের মধ্যেই টিকা খোলাবাজারে পাওয়া যাবে। আগাম সতর্কতা হিসেবে টিকা নিয়ে হয়তো এড়ানো যাবে এই মারণ ভাইরাসকে। কিংবা অদূর ভবিষ্যতে ওষুধ বেরোবে। তখন আগাম সতর্কতার দরকার হবে না। উপসর্গ দেখা দিলে ওষুধ খেলেই হবে।
করোনা আমাদের যাপনে আমূল বিবর্তন ঘটিয়েছে- এমনটা জোর দিয়ে বলার সময় বোধহয় এখনো আসেনি। বরং করোনা সভ্যতার বুকে এক ধরনের ‘মিউটেশন’ ঘটিয়েছে। মিউটেশন যেভাবে জিনে হঠাৎ করে একটা চিরস্থায়ী পরিবর্তন এঁকে দিয়ে যায়, এ যেন খানিকটা সেই রকম। কিছু কিছু পরিবর্তন আমাদের জীবনে হয়তো আগামী দিনেও থেকে যাবে।
ঝড় চলে গেলেও তার তা-বের চিহ্ন থেকে যায়। তার কিছু কিছু বেঁচে থাকে স্মৃতিচিহ্নের মতো।
অঘোর মন্ডল : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক
Leave a Reply